যশরাজ ফিল্মজ যখন চাক দে ইন্ডিয়ার জন্য শিমিত আমিনকে বেছে নিলো পরিচালক হিসেবে, তখন সিনেমার কেন্দ্রীয় চরিত্রের জন্য তার মাথায় অনেক নাম থাকলেও, শাহরুখ খানের নাম কখনোই ছিল না। অন্য যাদের নাম ছিল, তাদের উত্তর নেতিবাচক হওয়ার পরে প্রযোজক আদিত্য চোপড়া শিমিতকে বললেন- তুমি শাহরুখকে নিয়ে দেখতে পারো।
আদিত্যর এই কথা শুনে শিমিতের ভ্রু খানিকটা কুঁচকেছিল, আর সেটা তার চোখ এড়ায়নি। আদিত্য মুচকি হেসে শিমিতকে বললেন- তুমি একবার হলেও তার সাথে কথা বলে দেখতে পারো, এরপরই নাহয় সিদ্ধান্ত নিও। আমি শাহরুখ এর সাথে কাজ করেছি তো, আমি কিছুটা হলেও তাকে বুঝি। ওর সবচেয়ে বড় প্লাস পয়েন্ট কি জানো? ও নিজেও জানে না ওর অভিনয়ের ক্ষমতা কতটুকু। আর দুঃখের ব্যাপার হচ্ছে, এই জিনিসটা একই সাথে তার সবচেয়ে বড় দুর্বলতাও। তাছাড়া শাহরুখ কিন্তু নিজের কলেজে ওয়ান অফ দ্যা বেষ্ট হকি প্লেয়ার ছিল, তোমার স্ক্রিপ্টও সেটা ডিম্যান্ড করে। বাকিটা তোমার ইচ্ছা...
শিমিত অনেকটা নিমরাজি হয়ে শাহরুখের সাথে মিটিং করতে রাজি হলেন। তার ভ্রু কুঁচকানোর কারণ এটা ছিল না যে শিমিত আমিন শাহরুখকে পছন্দ করতেন না বা তাকে অভিনেতাই ভাবতেন না। বরং কারণ এটা ছিল যে- শিমিতের সিনেমায় কবির খান নামের যে ক্যারেক্টার ছিল, শাহরুখ ছিলেন তার একেবারে বিপরীত প্রকৃতির মানুষ। শিমিত এর আগে শাহরুখের হাতেগোনা কয়েকটি সিনেমা দেখেছিলেন, যেখানে আবেগের পরিপূর্ণ প্রকাশ হচ্ছে- নেচে, গেয়ে এমনকি কান্নাকাটি করে। আর কবির খান এমন একজন ক্যারেক্টার যে নিজের সমস্ত কষ্ট চাপা দিয়ে রাখে, তার কষ্টই তার শক্তি, সেটাই তাকে বাঁচিয়ে রাখে।
এছাড়া শিমিত যখনই এর আগে শাহরুখকে দেখেছেন- সবসময় দেখেছেন শাহরুখ একদমই হাসিখুশি থাকা আর নিজের দারুণ সেন্স অফ হিউমার দিয়ে আশেপাশের মানুষকে খুশি করা মানুষ। কিন্তু সমস্যাটা হলো, চাক দে ইন্ডিয়ার কবির খান হাসতে থাকা বা হাসাতে থাকা মানুষ না।
অবশেষে মিটিং এর দিন চলে এলো। শাহরুখকে শিমিত স্ক্রিপ্ট পড়ে শোনাচ্ছিলেন, অল্প কিছুক্ষণ শুনেই শাহরুখ বললেন- শিমিত, সিনেমাটা আমি করব। শিমিত অবাক হয়ে বললেন- 'স্যার, আপনি তো স্ক্রিপ্ট পুরাটা শোনেননি এখনও! আমি শেষ করি অন্তত, এরপরে নাহয় বলেন।'
শাহরুখ একদৃষ্টিতে শিমিতের দিকে তাকিয়ে বললেন- এই স্ক্রিপ্টের ওপরে কি তোমার বিশ্বাস আছে পরিচালক হিসেবে? শিমিত জবাব দিলেন- অবশ্যই আছে! শাহরুখ বললেন- তাহলে আমার আর কিছু জানার নেই। তোমার বিশ্বাস থাকলে আমারও আছে। আমার মরহুম বাবা আমাকে বলেছিলেন- জীবনে আর কিছু খেলি বা না খেলি, হকি খেলাটা যেন খেলি। এই সিনেমার মাধ্যমে আমি সেটা করতে পারব অনেকদিন পর। তাছাড়া যতটুকু শুনলাম তাতে বুঝে গেছি এটা শুধু খেলার সিনেমা না। এখানে নারীর ক্ষমতায়ন থেকে শুরু করে, মুসলিম-হিন্দু বিভাজন সবকিছুই এসেছে। সুতরাং, সিনেমাটা আমি করব।
শিমিত বেশ অবাকই হলেন। তিনি ভাবতেই পারেননি যে শাহরুখ স্ক্রিপ্ট এতটা মনোযোগ দিয়ে শুনেছেন, তাও আবার পুরোটা না শুনেই অনেককিছু বুঝে ফেলেছেন। তিনি বেশ সন্তুষ্ট হলেন। হুট করে তখন শাহরুখ আবার বললেন- আচ্ছা, আমার গেটাপ কেমন হবে কবির খান ক্যারেক্টারের জন্য? শিমিত জলদি বললেন- আপনাকে একদম নরমাল শার্ট প্যান্ট পড়তে হবে, তবে ফরমাল। শার্ট বেশিরভাগ সময় সাদা হলে বেশি ভাল হয়। এছাড়া কিছু জায়গায় টিশার্ট পড়তে পারবেন তবে জমকালো কিছু না। আর আপনার চুলটা একটু ছোট করতে হবে আর একটু দাড়ি রাখতে হবে... এই তো।
শাহরুখ ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলেন- দাড়ি? শিমিত বললেন- হ্যাঁ স্যার, কোন সমস্যা? শাহরুখ একটু ইতস্তত হয়ে বললেন- না মানে তেমন কিছু না। দাড়ি রাখাতে আমি আসলে খুব একটা কমফোর্টেবল না। কেমন যেন গাল চুলকায়... শিমিত বললেন- কিন্তু স্যার কবির খান ক্যারেক্টারের জন্য তো দাড়ি রাখতেই হবে। শাহরুখ জবাব দিলেন- আরে না না! দাড়ি অবশ্যই রাখব। এনিথিং ফর দ্যা ক্যারেক্টার। তুমি বললে শুধু গাল কেন, ক্যারেক্টারের জন্য শরীরের আরও অন্যান্য জায়গায় চুল গজানোর চেষ্টা করব!
চেষ্টা করেও হাসি আটকাতে পারলেন না শিমিত আমিন, হাসতে হাসতে বললেন- সেটার দরকার হবেনা স্যার। আপাতত যা বললাম সেটা করলেই হবে।
দুই সপ্তাহ পরে শাহরুখ যখন শুটিং স্পটে প্রথম এলেন, তাকে দেখে শিমিত একটা বড়সড় ধাক্কা খেলেন। শিমিত যেমনটি বলেছিলেন, শাহরুখ ঠিক সেভাবে এসেছেন- ফরমাল শার্ট প্যান্ট, ছোট চুল আর মুখে হালকা দাড়ি। শিমিতের বিশ্বাস হচ্ছিল না যে দুই সপ্তাহ আগে তিনি এই মানুষটার সাথেই আড্ডা দিয়েছিলেন, আর ইনি কবির খান ক্যারেক্টারের সাথে যাবেন কিনা সেটা নিয়ে সন্দেহে ছিলেন। শিমিতের মনে হচ্ছিলো- এটাই তো কবির খান!
এরপরের দিনগুলো শিমিতের জন্য ছিল এক দারুণ অভিজ্ঞতা। সারাক্ষণ শুটিং সেট মাতিয়ে রাখা, সবাইকে আনন্দে রাখা মানুষটা ক্যামেরা অন করলেই একদম গম্ভীর, তার আবেগ একদম কন্ট্রোলে। তার চেয়েও অবাক করার ব্যাপার ছিল, শাহরুখের নিজের একার যেসব দৃশ্যগুলো ছিল, সেগুলো তিনি রিহারসেল না করেই বেশিরভাগ সময় টেক দিতেন। আর ক্যামেরার পেছনে বসে শিমিত সেগুলো ওকে করতেন। শাহরুখের কেমন যেন একটা অদ্ভুত ক্ষমতা আছে বলে মনে হতো শিমিতের।
অনেকেই শিমিতকে জিজ্ঞেস করেছেন- চাক দে ইন্ডিয়া সিনেমার সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং দৃশ্য বা সিকোয়েন্স কোনটা? শিমিত অকপটে বলি- সিনেমার শেষ খেলার দৃশ্যটা। যখন ইন্ডিয়া জিতে যাচ্ছে আর শাহরুখ পতাকার দিকে অশ্রুভরা চোখে তাকিয়ে আছেন। এই সিনটার সময়ে মজার একটা ঘটনা হয়েছিল। শুটের আগে শিমিত এই দৃশ্যটা বারবার শাহরুখকে বোঝাচ্ছিলেন এভাবে- স্যার, আপনি পুরো সিনেমাতে কোথাও নিজের আবেগ প্রকাশ করেননি, এটাই একমাত্র দৃশ্য যেখানে আপনাকে আবেগ প্রকাশ করতে হবে, তবে খুবই পরিমিত পরিমাণে।
শাহরুখ সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন- যেমন? শিমিত বললেন- আপনার চোখে পানি আসবে, তবে সেই পানি আপনি চোখ থেকে ফেলবেন না, পানি আপনাকে চোখে জমিয়ে রাখতে হবে। একদম পানি ফেলা যাবে না। এটা স্যার খুবই ইম্পরট্যান্ট একটা দৃশ্য, একটা ন্যানোসেকেন্ড এখানে গড়বড় হলে সব শেষ। শাহরুখ বললেন- ওকে।
এমনভাবে ওকে বললেন, শিমিত ভাবলেন, দৃশ্যটা কি শাহরুখ আসলেই বুঝেছেন নাকি না বুঝেই ওকে বললেন? তিনি তাই আবার বললেন- স্যার, আপনি শিওর তো? আপনি বুঝতে পারছেন তো আমি কি চাচ্ছি? শাহরুখ হেসে বললেন- শিমিত, আমি সাত থেকে আট বছর থিয়েটারে কাজ করা মানুষ। এগুলো আমার কাছে নতুন কোন ব্যাপার না। এবার শিমিত হেসে বললেন- তাই নাকি? তা কতক্ষণ চোখের পানি না ফেলে চোখে জমিয়ে রাখতে পারবেন আপনি?
শাহরুখ চোখ টিপ দিয়ে বললেন- যতক্ষণ তুমি “কাট” না বলবে, ঠিক ততক্ষণ! শিমিত সাধারণত এধরনের কাজ করেন না, তবে এই ক্ষেত্রে শাহরুখকে পরীক্ষা করার লোভটা সামলাতে পারেননি তিনি। তার যখন কাট বলা উচিত ছিল এই দৃশ্যে, শিমিত তার বেশ কয়েক সেকেন্ড পরে “কাট” উচ্চারণ করেছিলেন, এবং সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে- শাহরুখ খান এই পুরোটা সময় নিজের আবেগকে সামলেছেন নিদারুণ অভিনয় দক্ষতায়। সিনেমার এই বিশেষ দৃশ্যটি যারা দেখেছেন, তারা একমত হবেন এই লাইনের সাথে।
সেদিন শিমিত শাহরুখের অভিনয় দক্ষতা সম্পর্কে তো ধারণা পেয়েছিলেনই, পাশাপাশি আরও একটা জিনিস পরিস্কারভাবে বুঝে গিয়েছিলেন পরিচালক হিসেবে- কবির খান ক্যারেক্টারটি শাহরুখ খানের চেয়ে ভাল করে আর কেউ ফুটিয়ে তুলতে পারতো না, কখনোই না...
আপনি এই ওয়েবসাইটটি ব্যবহার করছেন এর অর্থ হল: আপনি আমাদের ব্যবহারের শর্তাবলী মেনে নিয়েছেন।